মোঃ শাওন সরকারঃ পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে শুরু করে শীতল হাওয়ার ড্রইং রুম, সবখানেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু “পাপিয়া”। হ্যাঁ বলছিলাম, নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক “শামীমা নূর পাপিয়া”র কথা। ছোট বেলায় দাদু, নানু, মা, খালা, ফুফিদের কাছে ভূতুড়ে,রাক্ষস রাজ্যর গল্প শুনতাম। সেই গল্পে থাকতো গা ছমছম করা কল্প কাহিনী। ছোট বেলায় শোনা সেই গা ছমছমে ভূতুড়ে আর রাক্ষসপুরীর গল্প থেকে কোন অংশেই কম নয় “পাপিয়া”র রাজ্যের গল্প। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে ভূতুড়ে আর রাক্ষসপুরীর রম্য কাহিনীকেও হার মানায় “পাপিয়া”র রাজ্যের গল্প।
যদি শুরু করি “পাপিয়া”র কলেজ জীবনের গল্প থেকে তাহলে শুরুতেই বলতে হয়, ২০০৬ সালের দিকে নরসিংদী সরকারি কলেজে উদ্ভোধন হয় সর্বপ্রথম মহিলা হোস্টেল। আর সেই হোস্টেলের একটি কক্ষে “পাপিয়া” বানিয়ে ফেলেন তার জীবনের শুরুর রাজ্যের এক আস্তানা। কি চলতো না সেই আস্তানায়। এখান থেকেই শুরু “পাপিয়া”র পাপের রাজ্য। কলেজ হোস্টেলের সেই কক্ষেই মাদক সেবন থেকে শুরু করে দেহ ব্যবসা, টর্চার সেল আরো কত কি?
নরসিংদী সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় “পাপিয়া”র সাথে পরিচয় হয় স্বামী সুমনের সাথে। সেই পরিচয়ের সূত্রধরেই মন দেয়া-নেয়া। চুটিয়ে প্রেম, অতঃপর বিয়ে করে দুজন-দুজনার চির আপন হয়ে যাওয়া। স্বামী সুমনের হাতে হাত রেখেই রঙিন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু “পাপিয়া”র। সাধারণ ঘরের মেয়ে হয়েও সুমনের মাধ্যমে নরসিংদীর বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে পরিচয় হয় “পাপিয়া”র, আর এতে করেই বদলাতে থাকে “পাপিয়া”র ভাগ্য। সুমনের হাত ধরে রঙিন দুনিয়ায় প্রবেশ করলেও পরবর্তীতে সুমনকেও প্রভাব, প্রতিপত্তিতে ছাড়িয়ে যায় “পাপিয়া”। শুরু হয় তার অপরাধ জগৎের পদচারণা। প্রভাব, প্রতিপত্তি খাটিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখানো, বেপরোয়া জীবন-যাপন আরো কত কি?
স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ওরফে মতি সুমনের হাত ধরে রঙিন দুনিয়ায় প্রবেশ করলেও স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, সুমন ও “পাপিয়া” ছিল নরসিংদীর আলোচিত-সমালোচিত প্রেমিক যুগল। নরসিংদী সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই “পাপিয়া” সুমনকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। কিন্তু সুমন বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় “পাপিয়া” সুমনকে গুলি করে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়। এ নিয়ে কলেজেই সুমন ও “পাপিয়া” গ্রুপের মধ্য মারামারির ঘটনাও ঘটে। জানা যায়, “পাপিয়া”র সাথে সুমনের প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও সুমন “পাপিয়া” কে বিয়ে করতে চায়নি। পরবর্তীতে “পাপিয়া”র হুমকি-ধামকি জয়ী হয় এবং “পাপিয়া” চির আপন করে পায় স্বামী সুমন ওরফে মতি সুমনকে।
“পাপিয়া”র বাবা সাইফুল বারী আগে গণপূর্ত বিভাগের গাড়ী চালক ছিলেন। স্বামী সুমন ওরফে মতি সুমনের হাত ধরে পাপের রাজ্যের রাণী হন “পাপিয়া”। এক্সময় নরসিংদীর স্থানীয় রাজনীতিবিদদের বাইরে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে নানা ছলাকলায় পরিচিত হয়ে বাড়তে থাকে “পাপিয়া”র প্রভাব, প্রতিপত্তি, বাড়তে থাকে নরসিংদীর স্থানীয় নেতাদের সাথে দূরত্ব। একপর্যায় নরসিংদীর স্থানীয় নেতাদের অনীহা স্বত্বেও বাগিয়ে নেন নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি “পাপিয়া” কে।
রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলে গড়ে তুলেন অপরাধ জগৎের আস্তানা। কি ছিলনা “পাপিয়া”র সেই রাজ্যে, মাদক, নারী সবই ছিল। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার ঝনঝনানি, সব……সবই ছিল “পাপিয়া”র পাপের রাজ্যে।
সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলের মতো জগণ্য কর্ম পরিচালনা করে আয় করতে থাকেন কোটি কোটি টাকা। সমাজের উঁচুস্তরের মানুষের সাথে ছবিও তুলতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে আর এসব ছবি একেকজনকে দেখিয়ে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে নরসিংদী এলাকায় চাউর করে বেড়াতেন সংরক্ষিত নারী আসনের এম,পি হচ্ছেন তিনি।
অনুসন্ধানে “পাপিয়া”র পাহাড়সম সম্পদের হিসেব বের হয়ে আসে। নরসিংদী শহরের ভাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকায় একটি পাকা ও একটি সেমিপাকা টিনসেড বাড়ী আছে ‘পাপিয়া”র। টিনসেড বাড়ীটি ছিল “পাপিয়া”র টর্চার সেল। একই এলাকার বেলাদী মোড়ে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যর ১০ শতাংশ ও একটি ৬ শতাংশ প্লট রয়েছে “পাপিয়া”র। “পাপিয়া’র শ্বশুরবাড়ী ব্রাক্ষণদীতে স্বামী সুমনের দোতলা একটি বাড়ী আছে। রাজধানীর ইন্দিরা রোডে ‘রওশন ডমিনো রিলিভো’র বিলাসবহুল ভবনে তার ও তার স্বামীর দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া দুটি হাইচ মাইক্রোবাস, ১টি হ্যারিয়ার, ১টি নোয়া ও ১টি ভিজেল আছে।
উল্লেখ্য গত ২২ ফেব্রুয়ারি “পাপিয়া” ও তার স্বামী সুমন ওরফে মতি সুমন এবং তাদের দুই সহযোগীকে দেশত্যাগের সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার হন। এসময় তাদের কাছ থেকে ২লাখ টাকা, ইয়াবা, মদ ও জাল টাকা উদ্ধার করা হয়।
এরপরদিন তাদের নিয়ে নরসিংদী ও রাজধানীর ইন্দিরা রোডের ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে নগদ ৫৮ লাখ টাকা, অবৈধ পিস্তল ও গুলি, বিদেশী মুদ্রা ও মদ জব্দ করা হয়। পরবর্তীতে আদালতের আদেশে “পাপিয়া” ও সুমন ১৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। (ধারাবাহিক) ।